পলিথিন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এইটা আমরা সবাই জানি, কিন্তু কেনো ক্ষতিকর এইটা কী কখনো গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছি? পলিথিন নিয়ন্ত্রণে আইন রয়েছে, প্রচুর সংগঠন পলিথিন ব্যবহার কমানোর জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার কাজ করছে কিন্তু তারপরেও এতো মানুষ কেনো পলিথিন ব্যবহার করছে? পৃথিবীর ৭০০ বিলিয়ন মানুষ যদি পলিথিন ব্যবহার কমিয়ে দিতো, তাহলে আজকে পৃথিবীর অবস্থা কেমন হতো? সমুদ্রের তলদেশে এইযে এতো পলিথিন পাওয়া যাচ্ছে এগুলো কোথা থেকে আসে? পলিথিন নিয়ে এই সবগুলো প্রশ্নের উত্তর আজকে আমরা একটু গভীর থেকে জানার চেষ্টা করবো। পলিথিন কেনো আমাদের ছাড়া উচিৎ বা কেনো পলিথিনের ব্যবহার সীমিত করা উচিৎ সেটা নিয়েও আলোচনা হবে। পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন কেন আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ সেটা নিয়েই আজকের আমাদের আয়োজন!
পলিথিন কী?
পলিথিন মূলত একটি জৈব পলিমার। সাধারণত একটি ছোটো যৌগকে যখন উপযুক্ত তাপমাত্রা ও চাপ প্রয়োগ করে অনুকূল পরিবেশে পলিমারকরণ করা হয় তখন সেখানে একটি বড়ো আকৃতির অণু তৈরি হয়। প্লাস্টিকও ঠিক একইভাবে বানানো হয়ে থাকে। ইথিলিন নামক একটি ক্ষুদ্র যৌগকে প্রায় ২০০০ বায়ুমন্ডলীয় চাপ ও ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করে পলিইথিলিন বা পলিথিন বানানো হয়। এবার আসি পলিথিনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে-
- বর্তমানে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ অনেক বেশি সহজ হওয়ার কারণে এটি অনেক বেশি সস্তা।
- পলিথিন সাধারণত ছত্রাকের দ্বারা আক্রান্ত হয় না। যার জন্য দীর্ঘদিন অবিকৃত থাকে।
- পলিথিন তাপ বা চাপে খুব বেশি পরিবর্তিত হয় না।
- পলিথিনিকে খুব সহজেই একটি আকৃতি থেকে অন্য আকৃতিতে পরিবর্তন করা যায়, যার জন্য দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র বানাতে পলিথিন বহুল ব্যবহৃত একটি দ্রব্য।
- পলিথিনের পাত্রে জিনিসপত্র কম নষ্ট হয় এবং পোকামাকড় একে কাটতে পারে না।
পলিথিনের বৈশিষ্ট্যগুলো জানা হলো, কিন্তু এতে এমন কী আছে যার জন্য পরিবেশের জন্য পলিথিন এতো বেশি ক্ষতিকর? পরিবেশবাদীরাই বা কেনো পলিথিন বর্জনের জন্য এতো বেশি সোচ্চার? জানা যাক সে বিষয়ে।
পলিথিন ও পরিবেশের সম্পর্ক
পলিথিন মূলত একটি পলিমার যৌগ, যা বর্তমানে আমাদের প্রতিদিনকার কাজকর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ায় সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে এর ক্রয়মূল্য থাকে এবং একারণে আসলে পলিথিনের প্রতি মানুষ এতো বেশি আকৃষ্ট। পলিথিন ব্যাগ খুবই সহজলভ্য হওয়ার কারণে আমাদের শহরাঞ্চল্গুলোতে এর ব্যবহার অনেক বেশি পরিমাণে বেড়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। প্রতিদিনকার তরিতরকারির খোসা, উচ্ছিষ্ট দ্রব্য, মাছের আঁশ থেকে নিয়ে বাসাবাড়ির ময়লা-সবকিছুই পলিথিনের ব্যাগে ভরে ফেলে দেওয়া হয়। এতে করে যা হয়, এই উচ্ছিষ্টগুলো পলিথিনের ব্যাগের মধ্যেই পঁচে বাজে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে। পলিথিন যেহেতু ছত্রক দ্বারা আক্রান্ত হয় না তাই এটি মাটিতেও সহজে মেশে না। বরং একটি পলিথিন ব্যাগ মাটিতে মিশতে প্রায় ৫০ থেকে ১০০ বছরের বেশি সময় লাগে।
পলিথিন কীভাবে আপনার আমার আশেপাশের পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে?
- একটি পলিথিন মাটিতে মিশতে প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় লাগে। আমরা প্রতিদিন যেসব পলিথিনের ব্যাগ পরিবেশে ফেলে দিচ্ছি সেগুলো প্রায় সবই মাটির সাথে জমে থাকছে এবং আস্তে আস্তে মাটি দূষণের সবচেয়ে বড়ো কারণ হচ্ছে।
- পলিথিন যেহেতু একটি রাসায়নিক যৌগ তাই এটি খুব দ্রুতই বিক্রিয়া করতে পারে। মাটির সাথে বিয়োজন দেরীতে হওয়ার কারণে এটি মাটির আর্দ্রতা ও উর্বরতা কমিয়ে দেয়। একারণে যে এলাকার মাটিতে পলিথিন বেশি জমে সে এলাকার ফসল আস্তে আস্তে কমতে থাকে।
- পলিথিন খুব সহজেই ড্রেনের পানি ব্লক করে দেয়, যার জন্য জলাবদ্ধতা, পানি আটকে দুর্গন্ধ হওয়া ইত্যাদি শহরাঞ্চলে খুবই সাধারণ বিষয়।
শুধুমাত্র ঢাকা শহরের উপরে হওয়া একটি জরিপ বলছে, প্রতিদিন ঢাকা শহরের ৫০ লাখ পরিবার গড়ে ৪ টি করে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। যা কিনা দৈনিক পুরো শহরে ২ কোটি পলিথিন ব্যবহৃত হওয়ার সমতুল্য। এবং এই পরিমাণ পলিথিনের সবটাই মানুষ ফেলে দিচ্ছে তার আশেপাশে ডাস্টবিন বা খোলা জায়গায় যা কিনা পরবর্তীতে মাটি দূষণসহ পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে হাজারটা উপায়ে। চিন্তা করুন, একটি শহর থেকে একদিনে যদি ২ কোটি পলিথিন পরিবেশে মিশে যায় তাহলে পুরো বিশ্বে প্রতিদিন কতো শত কোটি পলিথিন পরিবেশে মিশে যাচ্ছে?
পলিথিন ও মানুষের স্বাস্থ্য
পলিথিন কীভাবে পরিবেশের সাথে মিশে গিয়ে এর উর্বরতা নষ্ট করছে সে সম্পর্কে আমরা জানলাম, এবার বরং একটু মানুষের দিকে তাকানো যাক। মানুষের শরীরে পলিথিন কী কী বিরূপ প্রভাব ফেলছে?
- পলিথিনে অনেক সময় আমরা হোটেল বা রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে যাই, কিন্তু চিকিৎসকেরা বলছেন পলিথিনে মোড়ানো গরম খাবার খেলে সেখান থেকে ক্যান্সার বা অন্ত্রের প্রদাহ হতে পারে।
- পলিথিনে মাছ/মাংস প্যাকিং করলে এর মধ্যে অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয় এবং পরে যখন এর থেকে মাছ মাংস বের করে রান্না করা হয় সেগুলো তখনও এসবের গায়ে লেগে থাকে। এবং পরবর্তীতে এই ব্যাকটেরিয়া পাকস্থলিতে গিয়ে নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করে।
- উজ্জ্বল রঙের যেসব পলিথিন বাজারে পাওয়া যায় তাতে সাধারণত সীসা বা ক্যাডমিয়াম থাকে। এই সীসা বা ক্যাডমিয়াম শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে সরাসরি বাধা দেয়, মানুষের দেহে কারসিনোজেনিক পদার্থ তৈরি করে যা থেকে পরবর্তীতে ক্যান্সার হতে পারে। এবং মানুষের স্নায়ুতন্ত্রকে দূর্বল করে দেওয়ার জন্য ক্যাডমিয়াম এক ধরনের স্লো পয়জন হিসেবে কাজ করে।
- মানুষের হরমোনের ভারসাম্যকে ভেস্তে দিতে পলিথিনজাত পণ্যের জুড়ি মেলা ভার কারণ এগুলোতে ধীর বিক্রিয়ার মাধ্যমে নানা ধরনের ক্ষতিকর আয়ন দেহে প্রবেশ করে যা কিনা পরবর্তীতে দেহের ভারসাম্য নষ্ট করে ও হরমোনজনিত নানা রোগে মানুষকে আক্রান্ত করে।
পলিথিন মূল্যের দিক থেকে অনেক বেশি সস্তা হলেও এর স্বাস্থ্যগত ক্ষতি ও পরিবেশগত ক্ষতি অবর্ণনীয়। প্রতিদিন পরিবেশে যে পরিমাণ পলিথিন অবমুক্ত হচ্ছে তা দিয়ে এই পৃথিবীকে কয়েকবার মুড়িয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু এরপরেও আমাদের সচেতনতা বাড়ছে না, বরং আস্তে আস্তে আরো বেশি করে পলিথিনের দিকে মানুষ ঝুঁকে পড়ছে, যা কিনা দীর্ঘমেয়াদী একটি ক্ষতির দিকে আমাদেরকে আস্তে আস্তে নিয়ে যাচ্ছে।
পলিথিনের বিষক্রিয়া থেকে বাঁচতে কী করবেন?
পলিথিন নিঃসন্দেহে একটি বর্জনীয় পণ্য। সস্তা, সহজলভ্য হলেও এটি আমাদের জীবনকে যতোটুকু সহজ করেছে পরিবেশকে তার চেয়ে হাজার গুণে বেশি দূষিত করেছে। তাই সময় থাকতেই আমাদের পলিথিনের বিরুদ্ধে অভিযানে নামতে হবে, নাহলে ইতিহাসে শুধুমাত্র পলিথিনের জন্যই হয়তো আমাদের বিলুপ্তির গল্প লেখা হবে। যেমনটা হয়েছিল সীসার পাত্রে পানি পান করা জাতির ক্ষেত্রে।
পলিথিনের ব্যবহার কমাতে-
- বাজার করার সময় পাট/চটের ব্যাগ ব্যবহার করতে পারেন।
- সবসময় ব্যাগ বহন করা ঝামেলা মনে হলে ছোট্টো একটি কাপড়ের ব্যাগ সাথে রাখতে পারেন।
- রেস্টুরেন্ট থেকে যখন খাবার নিচ্ছেন কাগজের প্যাকেট বা রিইউজেবল টিফিন ক্যারিয়ারে খাবারটা নিতে পারেন।
- রান্নাঘরে প্লাস্টিক র্যাপারের পরিবর্তে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল বা কাপড় ব্যবহার করতে পারেন।
আপনি বা আমি যদি আমাদের জায়গা থেকে একটি পলিথিনও কম ব্যবহার করি সেটাই হয়তো পরিবেশের প্রতি ছোটো একটি ইতিবাচক পরিবর্তন হতে পারে। আমাদের উদ্যোগটা ছোটো হলেও আস্তে আস্তে ছড়িয়ে যেতে হয়তো বেশি সময় নেবে না, একটা সময় একজন দুইজন করে হাজার লক্ষ মানুষ সচেতন হবে!
সারকথা
পলিথিন আমাদের পরিবেশের জন্য আক্ষরিক অর্থেই একটি বিষের নাম, তাই আমাদের উচিৎ এই বিষ পরিবেশ থেকে উৎপাটন করা ও আর পরিবেশে এই বিষ প্রয়োগ না করা। যে যার নিজের জায়গা থেকে যদি একটি দুইটি করে প্লাস্টিক পণ্য আমরা বর্জন করা শুরু করি তাহলে একটা সময় একেকটা এলাকা পলিথিন-মুক্ত হতে বেশি সময় লাগবে না! তাই সচেতনতা শুরু হোক আপনার আমার থেকেই!
ঘোষণা : নেচার টকিজ ব্লগের সমস্ত লেখা, লেখক বা লেখিকার সম্পূর্ণ নিজস্ব মতামত, সাধারণ মানুষ পরিবেশ সচেতনতার নিয়ে এখানে লিখছেন। লেখা বা প্রবন্ধ সম্পর্কিত কোনো মতামত বা অভিযোগ থাকলে আমাদের জানান, আমরা বিষয়টি অবস্যই গুরুত্ত্ব সহকারে দেখবো !
যোগাযোগ : editor@naturetalkies.com